জনমত বিনির্মাণ : গণমাধ্যম প্রেক্ষিত
মানুষ অভিযোজন ক্ষম প্রাণী। সময়ের সাথে সাথে সামাজিক পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট আর বয়সের উর্ধ্ব গণণ ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ব্যপ্তিকে ক্রমেই বাড়িয়ে তোলে। আর তাই, আবর্তিত সময়ের সাথে সাথে আচরণের গতি ও মাত্রাবোধে আসে পরিবর্তন। এ প্রসঙ্গে শহীদ মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত উক্তি প্রনিধান যোগ্য, “মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়”। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও চিন্তার পরিসর দিয়ে প্রতিটি মানুষের আচরণ বোধ করি নিয়ন্ত্রিত এবং প্রকাশিত হয়। জীবন গল্পে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির আচরণ ও মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটা খুবই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আচরণের নেতিবাচক বিবর্তন। সামাজিক আচরণ এবং মূল্যবোধের ক্রম উন্নতির জন্য সমাজে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ, সমাজের জন্য অবশ্যই মঙ্গলজনক। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং এই লক্ষে কাজ করা সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতা। প্রবণতার এই ধারাবাহিক প্রয়োগের ফলেই সমাজের বিকাশ।
সভ্যতার বিবর্তনে, এক সময় সমাজে দিশা সৃষ্টি করতেন রাজা, গোত্র প্রধান কিংবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ধর্মগুরু। সমাজ কিংবা গোত্রের সকলেই প্রভাবিত হতেন তার নেতৃত্বে। অস্তিত্বের প্রয়োজনেই এটি ছিল স্বীকৃত হায়ারার্কি। ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দের কথা। ফরাসী সিউলফ খ্যাত রানী ইসাবেলা ইংলিশ রাজার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং নিজ স্বামী রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আর্চ বিশপ অব ক্যান্টারবেরি ওয়াল্টার রেনল্ড জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলতে রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ডের বিরুদ্ধে প্রচার করতে লাগলেন নিজস্ব অভিযোগনামা …….Vox populi, vox dei “সাধারণের ইচ্ছেই ঈশ্বরের ইচ্ছে”। রেনল্ড তার অভিযোগনামার মাধ্যমে কৌশলে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করার প্রয়াস রচনা করেন। বলতে থাকেন, আসুন এই অযোগ্য রাজার হাত থেকে আমাদের পিতৃভূমিকে মুক্ত করি । সাধারণ জনগণ উদ্দীপিত। জনগণের ইচ্ছে মানেই “ঈশ্বরের ইচ্ছে” এমন অশ্রুতপূর্ব অসম্ভব বাক্যে আবেগ তাড়িত হয়ে উঠেছেন সকলে। নিজেদের সব সামর্থ্য দিয়ে যুক্ত হলেন নতুন রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের সাফল্য রচনায়। কৌশলী সকল কর্মকান্ডের সমন্বিত ফলাফলে ফরাসী রাজকন্যা ইংলিশ রাজবধূ হয়ে উঠলেন ইংরেজ সিংহাসনের ক্ষমতাসীন রানী আর ফরাসী সেনাপতি রজার মোল্টিমা মূল ক্ষমতার উৎস অঘোষিত রাজা। আর যিনি রাজা হবার কথা, রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড, তিনি তখনো নাবালক! জনমতসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের পরিকল্পিত ব্যবহারে দিশা সৃষ্টির এরকম অজস্র উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ইতিহাসের পরতে পরতে।
আজকের দিনে দিশা সৃষ্টির অসামান্য সুযোগ সমাজে বাসকারী প্রতিটি মানুষই কাগজে কলমে সমান ভাবে ধারণ করেন। সামাজিক বিকাশ আজ উত্তর আধুনিকতার শীর্ষ স্তরে বিকশিত। গণতান্ত্রিক বিকাশের অন্যতম সুফল ব্যক্তি স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক পরিবেশে প্রতিটি ব্যক্তির সুযোগ রয়েেেছ নিজস্ব বক্তব্য অপরের নিকট তুলে ধরার। নিজস্ব মতের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার প্রয়াস রচনায়, নেতৃত্ব প্রদানে অগ্রসর হতে পারেন, সমাজের প্রতিটি জন। ধারাবহিক বিকাশের এটি বিশাল অর্জন। মূলত, জনমত হচ্ছে সমাজের কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট সময়ে লালনকৃত চিন্তার বহিঃ প্রকাশ। বৃহত্তর দৃষ্টিকোনে, জনমত হচ্ছে আকর্ষণী ক্ষমতাযুক্ত বিশেষ গতিশীল মত উপাদান, যার মাধ্যমে সমাজের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর ধারণকৃত চিন্তার প্রতি বৃহত্তর অংশকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা রচিত হয়।
কোনও প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা প্রনয়নকালে করণীয় কাজটি নতুন ভাবে করা কিংবা নতুন ধারণা অথবা উদাহরণ দিয়ে আলোচনা হয় অজস্র । বিশেষ করে উঠতি বয়সের নবীন কর্মীরা সব সময়ই আরো নিখুঁতভাবে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন। প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নতুন কৌশলের প্রতি তাদের আগ্রহ দেখিয়ে থাকেন। আলোচনার টেবিলে এসব নবীন ভাবনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নতুনত্বপূর্ণ, গঠনমূলক এবং লোভনীয়। এই যে নতুনত্বপূর্ণ, গঠনমূলক এবং লোভনীয় আলোচিত কৌশল বা নতুন কিছু করার ধারণা, এটিই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর ভাবনা। গবেষণায় দেখা যায়, সমাজ বিনির্মানে বৃহৎ গোষ্ঠীর ভাবনা সচরাচর পুরাতন ধ্যান ধারণা প্রবণই হয়ে থাকে এবং সমাজের অধিকাংশের লালিত জনমত হচ্ছে প্রতিক্রিয়ামুখী একটি ধীর প্রক্রিয়া, যা নতুন ধারণাকে সহজে আত্মীকরণে অনভ্যস্ত।

জনমত বিনির্মাণের উপকরণসমূহ।
আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে, তার ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রতিপক্ষ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী স্টেফিন ডগলাস-এর সাথে ইলিনয়েসে এক বিতর্কে বলেছিলেন, “Public sentiment is everything. With public sentiment nothing can fail. Without it nothing can succeed”. পাবলিক সেন্টিমেন্ট-এর দুষ্ট ব্যবহার করে পৃথিবীতে অজস্র যুদ্ধ যেমন সংগঠিত হয়েছে আবার একই সাথে এর নিপুন ব্যবহারে অজস্র জাতি স্বীয় উন্নতির শিখরেও আসন লাভ করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তর জার্মান জাতিকে উন্নতির পথে ধাবিত করেছে পাবলিক সেন্টিমেন্ট-এর সুনিপুন ব্যবহার। আবার একই সাথে পাবলিক সেন্টিমেন্ট-এর মাধ্যমেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের সূচনা! ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী জাতীয়তাবোধ লালন এবং মননে এদেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালে দেশের সকল জনগোষ্ঠীর মাঝে যুদ্ধ পরিবেস্টিত অবস্থায়ও স্বাধীনতাবোধ তীব্রকরণে এবং এই বিষয়ে পাবলিক কনসেন্ট বা জনমত বিনির্মাণে পরিবেশগত আনুকূল্যের কারণে বেতার মাধ্যম অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ, আলবার্ট আইনস্টাইন তখন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং শিক্ষক। একদিন সিনিয়র ক্লাসে ফাইনাল টেস্টে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রশ্ন বিতরণ করছিলেন। পরীক্ষার হলে আইনস্টাইনের প্রশ্নপত্র দেখে বিস্মিত হন তাঁর সহকারী । অবাক হয়ে দেখেন, আইস্টাইন গত বছরের প্রশ্নপত্রটিই হুবহু নতুন প্রিন্ট করে বিতরণ করছেন। সহকারী তড়িঘড়ি করে আইনস্টাইনের কাছে ছুটে যান এবং প্রশ্ন করেন, মিস্টার আলবার্ট আইস্টাইন, আপনি কি গত বছরের ব্যবহৃত একই প্রশ্ন পত্র শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করছেন না? এইটি কি ঠিক হচ্ছে? আইনস্টাইন দ্বিগুন পরিমান অবাক হলেন। তিনি গম্ভীরভাবে তার সহকারীকে বললেন, দেখ প্রশ্নগুলো গত বছরের হলেও উত্তরগুলো বদলে গেছে! আইনস্টাইনের এই বদলে যাওয়া উত্তরের বিষয়টিকে মাথায় নিয়েই ভাবছি, ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে যদি কোন বিদগ্ধ পাঠককে প্রশ্ন করা হতো, আচ্ছা জনমত বিনির্মাণ সহায়ক মিডিয়া বলতে কি বুঝায়? নিশ্চিতভাবেই, উত্তরে বলতেন সংবাদ পত্র, সাপ্তাহিক পত্রিকা ইত্যাদি। একই প্রশ্ন যদি, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে করা হয়? উত্তরে নিশ্চয়ই সংবাদপত্রের সাথে বেতার শব্দটিও যুক্ত হতো। প্রশ্নটি ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে করা হলে, পূর্বের উত্তরের সাথে যুক্ত হতো টেলিভিশন। আজকে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে এসে একই প্রশ্নের উত্তরে আমরা কি বলব? মিডিয়া কনভার্জেন্সের কল্যাণে আজকে প্রচলিত এবং নতুন মিডিয়া সব মিলে মিশে মিডিয়ার সংজ্ঞায় নতুন উত্তর যুক্ত হয়েছে। মূলত মিডিয়ার সংজ্ঞা নির্ধারণে আমাদের বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, প্রশ্নগুলো একই আছে, উত্তরগুলোই বদলে গেছে! আর এই বদলে যাওয়া উত্তরগুলো যদি আমরা আমাদের অনুকূলে লিখতে চাই, সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন সমসাময়িক মিডিয়ার ভূমিকা নির্ধারণে সমাজের চাহিদা এবং অংশীজনদের ভাবনাগুলোকে জনস্বার্থে অনুকূলে রূপান্তরের প্রয়াস রচনার বিষয়টিকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়া। একটি দেশের গণমাধ্যম দেশের জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সামাজিক উন্নয়ন ইস্যুতে জনমত বিনির্মাণে কাজ করে থাকে। আমাদের দেশে এটি আরও ফলপ্রসুভাবে করার জন্য প্রয়োজন গণমাধ্যমগুলোর আধুনিকায়ন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অবসান এবং পর্যাপ্ত সক্ষমতার উন্নয়ন। একই সাথে প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা ও প্রকাশনা কার্যক্রম। গবেষণা লব্ধ ফলাফলের ব্যাপক প্রয়োগের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সক্ষমতা। প্রয়োজন পেশাগত দক্ষতায় একই প্রাতিষ্ঠানিক বলয়ে সকল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনাকরণ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ঊষা লগ্ন। ব্রিটেন জুড়ে, শিল্পায়নের বিকাশে সমাজে নব্য শ্রমিক শ্রেণীর বিকাশ ঘটছে। কৃষি কাজের তুলনায় পেশাজীবি কাজে অনেক বেশী পারিশ্রমিক আর শ্রমের পরিমানও তুলনামূলক কম। জীবনকে উপভোগের সুযোগ আর স্বাধীনতাও বেশী। এমনি পরিস্থিতিতে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই অক্টোবর ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কোম্পানীর যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠানটি ১৪ই নভেম্বর লন্ডনের মার্কনী হাউজ (2LO) থেকে প্রথম অনুষ্ঠান প্রচার করে। কোম্পানীর প্রথম জেনারেল ম্যানেজার জন রিথ বিশ্বাস করতেন, শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে সমাজের উদীয়মান শ্রমিক শ্রেণীর প্রভাবে পরিবর্তিত সামাজিক গণ সংস্কৃতির ধারাকে অবজ্ঞা বা ভয় পাবার কিছু নেই বরং প্রয়োজন এটিকে সমাজের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য সঠিক পথে পরিচালিত করা। প্রয়োজন মূল্যবোধের স্বতস্ফূর্ত বিকাশে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। জন রিথ ব্রডকাস্টিং-এর মাধ্যমে সামাজিক সুষম বিকাশের সুযোগ দেখতে পান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, রেডিও সেট থেকে লব্ধ আয়ের অপ্রতুলতার কারণে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কোম্পানী প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রচন্ড অর্থ সংকটের মুখে পড়েন এবং পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে দেউলিয়া ঘোষিত হন। জন চার্লস ওয়ালসএম রিথ সংক্ষেপে জন রিথ-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় পরবর্তীতে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) নামে রাজকীয় সনদের মাধ্যমে নতুন ভাবে যাত্রা শুরু করে ব্রিটেনের প্রথম সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান।

বিবিসি’র প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল জন রিথ (২০ জুলাই ১৮৮৯ – ১৬ জুন ১৯৭১ খ্রিস্টব্দ)।
বিবিসি’র-এর প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল জন রিথ । মূলত, দেশের গণ সংস্কৃতির উন্নয়নে, দেশের আপামর জন সাধারণকে সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সকল অঙ্গনের বহুবিধ তথ্য প্রদান এবং একই সাথে বিনোদন প্রদানের পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন দ্বন্ধমূলক বিষয়ে জনগণকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে শ্রোতার নিকট প্রয়োজনীয় শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ তুলে ধরার মাধ্যমে শক্তিশালী গণ সংস্কৃতির ভিত্তি বিনির্মানে সম্প্রচারের সম্ভাবনার বিষয়টি প্রথম উপলব্ধি করেন জন রিথ । মূলত সম্প্রচারের মাধ্যমেই ব্রিটিশ আর্ট গ্যালারী থেকে শুরু করে ওয়েস্ট মিনিস্টারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের সকল বার্তা নিমিষেই ভোক্তার লিভিং রুমে উপস্থাপনের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। জন রিথ মনে করেন, গণ সংস্কৃতির বিকাশে সম্প্রচার কার্যক্রম ডিমান্ড ফলোয়িং না হয়ে বরং এটি হবে সাপ্লাই লিডিং। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মূল্যবোধের সাথে সমন্বয় এবং নব্য উদীয়মান শ্রমিক শ্রেণীর চিন্তা, সামজিক রুচি ও মূল্যবোধের সঠিক বিকাশে সম্প্রচার হবে ইকোয়েলাইজিং ফোর্স। ইতিবাচক জনমত বিনির্মানে সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান সমাজে নতুন ধ্যান ধারণা এবং উদ্ভাবনী বিষয়সমূহ সম্পর্কে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। শ্রোতার প্রতি দিনকার পরিচিত বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে শিল্পকলা, দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান-এর উদ্ভাবনী বিষয় সম্পর্কে মানুষকে আকৃষ্ট করবে। রিথ মনে করেন, একজন নব্য বিকাশমান ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা প্রতিষ্ঠান সব সময় জানেন না, নিজস্ব বিকাশ ত্বরান্বিত করণে কি প্রয়োজন! প্রয়োজনের বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধির জন্য সেবার উপস্থিতি সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকাও অত্যাবশ্যক। সুতরাং গণ রুচিবোধ বিনির্মানে নেতৃত্ব প্রদানই সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করতেন জন রিথ। আর এ কারনেই পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবিসির কার্যক্রমকে জন রিথ প্রকাশ করেন তিনটি মাত্র শব্দে দিয়ে। তিনি মনে করেন, জন স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে “তথ্য, শিক্ষা এবং বিনোদন”-এই তিনটি শব্দের মাঝেই নিহিত আছে পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। জন রিথ-এর বক্তব্য হচ্ছে, সমাজের যা কিছু ভাল তার জনপ্রিয়করণ এবং যা কিছু জনপ্রিয় তার মাঝে ভালোর বিকাশ ঘটানোর লক্ষে জনমত প্রতিষ্ঠায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং প্রতিষ্ঠানের প্রধানতম দায়িত্ব।
যুক্তরাজ্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশ কিংবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে দূর প্রাচ্যের ইন্দেনেশিয়া সকলের কাছেই জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করণে পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং একটি বহুল চর্চিত বিষয়। স্মিথ (২০১২) -এর মতে, পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং ব্যবস্থায় যখন অর্থায়নের স্বাধীনতা, সম্পাদকীয় স্বাধীনতা, অনুষ্ঠান নির্মানের বৈচিত্র্য, কার্যক্রমের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতসহ তথ্যসূত্রের একাধিকত্ব নিশ্চিত করা যায়, তখন পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিকাশ ও পরিপক্কতায় ভিত্তি প্রস্তর হিসাবে কাজ করে থাকে। স্লাভকো স্পিচাল (২০০৭)-এর মতে, সংবাদপত্র তার পাঠকদের কখনই গল্পের তাৎক্ষনিক স্বাক্ষী বানাতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে, স্পিচাল-এর বক্তব্য হচ্ছে, সংবাদপত্রে কোন ঘটনার বর্ণনায় সাধারণত, প্রয়োজনীয় অংশে বোদ্ধা মতামত নেয়া হয়, যেখানে প্রাসঙ্গিক অঙ্গনের সেলিব্রিটিগণ অংশগ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু গল্পের উপস্থাপনায়, গল্পের আকর্ষণীয় করণে সাধারণ শ্রোতা-দর্শকদের অংশগ্রহণ নিয়ে তাৎক্ষনিক প্রচারযোগ্য কার্যক্রম শুরু করে প্রথমত রেডিও এবং পরবর্তীতে টেলিভিশন। সাধারণ ভোক্তার সরাসরি অংশগ্রহণ কৌশলের নিপুন প্রয়োগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, অভিনয় শিল্পী এবং প্রযোজকগণ ব্যাপক জনপ্রিয়তা ইতোপূর্বে অর্জন করেছেন এবং আজও করছেন। এর ফলশ্রুতিতে, এ ধরনের অনুষ্ঠান সার্বজনীন দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠে। কৌশলী উপস্থাপনার এই ধরনের অনুষ্ঠান নাগরিক যোগাযোগ এবং মত বিনির্মাণে সহায়ক। সাধারণ শ্রোতার অংশগ্রহণে এমনই একটি বেতার অনুষ্ঠান “ডেজার্ট আইল্যান্ড ডিস্ক”। অনুষ্ঠানটি ১৯৪২ সালে বিবিসি রেডিওতে শুরু হলেও বিবিসি রেডিও ফোরে আজও টিকে আছে ভোক্তার সরব অংশগ্রহণের মাধ্যমে। টেলিভিশনের ক্ষেত্রে বিবিসি মিডিয়া এ্যাকসন প্রযোজিত “বাংলাদেশ সংলাপ” হতে পারে এমনই একটি উদাহরণ।
বর্তমান যুগে আমরা প্রায়শই শুনতে পাই “ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী” কিংবা “বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়”। কিন্তু এই চিরাচরিত বক্তব্যটি যতটা সত্য বলে আমরা বিশ্বাস করি, ঠিক ততটাই অসত্য। পৃথিবী আজ যতটা ছোট হয়েছে, ঠিক ততটাই বিকশিতও হয়েছে। পৃথিবীর দৃশ্যমান সীমারেখা আজ অজ¯্র গুনে সম্প্রসারিত। অতীতে একজন নেতা অনেক বেশী খোলামেলা ভাবে তার অনুসারীদের সাথে চলাফেরা করতেন এবং সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতেন। নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল অপেক্ষাকৃত কম বিবেচ্য । আজকের সমাজে পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে, নেতৃবৃন্দ তাদের অনুসারীদের কাছ থেকে স্পষ্টতই অনেক দূরে থাকেন। কিন্তু তা সত্বেও দেশের নাগরিক এবং অনুসারীরা তাদের নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে অতীতের তুলনায় এখন অনেক বেশী জানেন এবং তাদের কর্মকান্ডের সাথে অনেক বেশী পরিচিত থাকেন। এটি সম্ভব হয়েছে, আধুিনক মিডিয়ার অসাধারণ বিকাশের কারণে। মিডিয়ার কৌশলী সহায়তায় একজন নেতা আজ যে কোনও সময়ের তুলনায় অধিক ক্ষমতাশালী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পাচ্ছেন। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় অব্যাহত বিকাশমান এই মিডিয়ার আশ্রয়ে আজকের দিনের একজন নেতা তার অনুসারীদের নিকট নিজস্ব বক্তব্য এবং সম্পর্ক স্থাপনে সকল ভৌগলিক দূরত্ব এবং সামাজিক শ্রেণীভেদকে অতিক্রম করেন নিমিষেই।
কৌশলী জনমত বিনির্মাণ অথবা বলা যেতে পারে গণ জাগরণ সৃষ্টিকরণ বিষয়টির ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই ধরনের প্রয়োগই সমাজে ঘটতে পারে। ইতিবাচক প্রয়োগই বর্তমান প্রবন্ধের আলোচনার বিষয়। সরকারী কর্তৃত্ববাদ এবং রাজনৈতিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে গণমানুষের কল্যাণে উন্নয়ন ইস্যুতে জন মতের কৌশলী বিনির্মাণ মানব সভ্যতায় যুগ যুগ ধরেই স্বীকৃত একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব মতামত প্রকাশ বা বাক স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। একটি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান জন মানুষের কল্যাণে কোন একটি বিষয়ে অভীষ্ট জনগোষ্ঠীকে নিজস্ব মতের অনুসারী করণে চেষ্টা করতেই পারে। মত বিনির্মাণে আলোচ্য বিষয় নিয়ে শ্রোতা-দর্শকদের কাছে যাওয়া, যৌক্তিক বহুবিধ বিশ্লেষণে সমাধানের বিকল্প ধারণাসমূহ উপস্থাপন, অনুকূলে-প্রতিকূলে বক্তব্য উপস্থাপন, স্বাধীন মত উপস্থাপন, প্রিন্ট মিডিয়ায় বিশ্লেষণী মতামত পর্যালোচনা, বেতার টেলিভিশনে আবেগ জড়িত হৃদয়স্পর্শী প্রতিবেদন সম্প্রচার -এ সবই আমাদের সংবিধানের লালিত স্বীকৃতি।

এডওয়ার্ড এল বার্নেস (২২ নভেম্বর ১৮৯১ – ৯ মার্চ ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ)।
একজন জন প্রতিনিধি মূলত একজন জন বক্তা। বিভিন্ন গোষ্ঠী, দল বা জনসাধারণের বিভিন্ন ইস্যুতে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে জন প্রতিনিধিরা নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। জনস্বার্থ সংরক্ষণে একজন জন প্রতিনিধি অপর প্রতিপক্ষ নেতা বা দলের সাথে তুমুল শব্দ যুদ্ধে লিপ্ত হন। এডওয়ার্ড বার্নেস-এর মতে, “একজন জননেতা মিডিয়া জগতের পেশাদারী বিশেজ্ঞদের সহায়তায় উদ্দেশ্যমূলক ও বৈজ্ঞানিকভাবে তার অনুসারীদের মাঝে নিজ মতবাদের সমর্থনে জনমত সৃষ্টি করতে পারেন”। বার্নেস-এর মতে, এটি হচ্ছে জনমতের কৌশলী বিনির্মাণ বা “দি ইঞ্জীনিয়ারিং অব কনসেন্ট”। এ প্রসঙ্গে বার্নেস আরো বলেন, একটি রাজনৈতিক দল বা বৃহত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে শেষ পর্যন্ত গণ অনুমোদনের উপরই নির্ভর করতে হয়। অধিকাংশ মানুষ যখন হ্যা বলেন এবং কাঙ্খিত বিষয়ে গণজোয়ার সৃষ্টি সম্ভবপর হয়, তখন কাজটি এগিয়ে নেয়া সহজতর হয়ে উঠে। এ প্রসঙ্গে বার্নেস জোর দিয়ে বলেন, “শেষ পর্যন্ত সকলকেই জনগণের মতামত বিনির্মাণ সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলা করেই নিজস্ব প্রকল্প বা লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে হয়”। মূলত, মত বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায়, কার্যক্রমের অভীষ্ট লক্ষ্য পূর্ব থেকেই সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে নিতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ, ২০১৭ সালের নভেম্বর মাস। উত্তর কোরিয়াতে ব্যাপক বৃষ্টি আর বন্যার কারণে হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষের এই মর্মান্তিক প্রাণহানীতে বিশ্ব মিডিয়া সরব হয়ে উঠেছেন। এ দিকে রাষ্ট্রপতি কিম জং উন পশ্চিমের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে একের পর এক ব্যালেস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েই যাচ্ছেন। এ অবস্থায় বন্যা আক্রান্তদের জন্য পশ্চিমের আম জনতার মাঝে মানবিক বোধ সৃষ্টি এবং সাহায্য আদায় এক অসম্ভব প্রয়াস! তথাপি, মানবিক সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহের জন্য যদি কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়ও, সেক্ষেত্রে তহবিল সংগ্রহের সময়সীমা এবং কত টাকা সংগ্রহ করা হবে তার সর্বোচ্চ সীমা পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এই তহবিল সংগ্রহ কার্যক্রমে বৃহত্তর সারা সৃষ্টি এবং সফল করার জন্য কোন সাধারণ ভৌগলিক এলাকা, যেমন: ইউরোপ/ এশিয়া টার্গেট না করে বরং নির্দিষ্ট দেশ বা আরো সুনির্দিষ্ট স্থানের টার্গেট করে কাজ করলে লক্ষ্য অর্জন অনেকটা সহজতর হয়।

“জনমত বিনির্মাণ : গণমাধ্যম প্রেক্ষিত” প্রবন্ধটি জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট জার্নাল ৩য় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। পৃষ্ঠা নম্বর ৮৩।
জনমত বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায়, অভিষ্ট গোষ্ঠীর উপযোগী ভাষায় মিডিয়ার সহায়তায় উদ্দেশ্যমূলক বার্তা হেবারমাস (১৯৯২) প্রস্তাবিত কাঙ্খিত বলয় (পাবলিক স্ফেয়ারে) ছড়িয়ে দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে, বিনির্মাণ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য উপস্থপন এবং শব্দ চয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর আচরণ পরিবর্তনে যে সব উপকরণ একজন বিনির্মান বিশেষজ্ঞ ব্যবহার করবেন তাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে পূর্ব থেকেই ষোল আনা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। সহজ, বোধগম্য এবং প্রাঞ্জল শব্দের ব্যবহার বক্তব্য উপস্থাপনে বাঞ্ছনীয়। প্রতিটি বাক্যে শব্দ সংখ্যা ১৬ থেকে ১৮-এর মধ্যে থাকলে বক্তব্য সহজ পাঠ্য হয়ে উঠে। আচরণগত পরিবর্তন সাধনে একটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর মাঝে আকর্ষণ সৃষ্টিকারী চটকদার গল্প পরিবেশন। বিনির্মাণ বিশেষজ্ঞ আগ্রহ উদ্দীপক গল্প উপস্থাপন করে কৌশলে কাঙ্খিত বক্তব্যটি লক্ষ্যদলের মাঝে ছড়িয়ে দেন। লক্ষ্যদল নিজেদের অজান্তে গল্পটি সম্পর্কে জানেন, বিমোহিত হন এবং আচরণগত পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় নিজেদের শামিল করেন। মিডিয়া জগতে তথ্য সব সময়ই একটি অজড় উপাদান। এর মাঝে গতিশীল মাত্রা যেমন থাকে, তেমনি নিহিত থাকে নির্ভরশীল তথ্য সূত্র। প্রতি মুহুর্তে জন থেকে জনে বিস্তারে সক্ষম তথ্য সম্বলিত বক্তব্য কার্যকরভাবে পরিবেশিত হলে সংশ্লিষ্ট জনদের মাঝে ভাবনা ও চিন্তনের বীজ বপিত হয়। এই প্রসঙ্গে পাবলিক রিলেশন্স-এর জনক এডওয়ার্ড বার্নেস (১৯২৮) বলেছেন, “যেখানে বহু লোকের সংশ্লিষ্টতা বিরাজমান, এমন সংবাদ সৃষ্টি করার মত ঘটনা সাধারণত দৈবাৎ ঘটে না। এ সকল ঘটনা উদ্দেশ্যমূলক এবং পরিকল্পিতভাবেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে করা হয়ে থাকে”। জনমত বিনির্মাণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের চিন্তা এবং কর্মকে প্রভাবিত করার প্রয়াস রচনা করা হয়। সামাজিক বিকাশে কৌশলী জনমত বিনির্মাণ প্রক্রিয়ার জন্য সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে স্পর্শ করার মূল চাবি কাঠি হচ্ছে সামষ্টিক মিডিয়া। জনমত বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় মিডিয়া আউটলেটসমূহের বিচ্ছিন্ন প্রয়াস তুলনামূলকভাবে কম কার্যকর।
গল্পটি ১৯৩০-এর দশকের। উঠতি অর্থনীতির দেশ আমেরিকার তামাক শিল্প নিজেদের ভিত রচনায় সংগ্রামরত। মার্কিন মুলুকে সিগারেট ব্যবসাকে আরো ঝাঁকিয়ে বসানোর জন্য চলছে নানা কসরত। রকমারি বিজ্ঞাপন আর চটকদার বানী দিয়ে চলছে তুমুল লঙ্কাকান্ড। কিন্তু কিছুুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। মার্কেট রিটার্ণেও ঘটছে না উর্ধ্বমুখী তেমন আস্ফালণ। সমাজে ধুমপান বিষয়টিরও নেই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। মেয়েরাতো একে বারেই না। গল্পের এমন ক্লাইমেক্সে মঞ্চে আগমন করেন মার্কিন তামাক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জর্জ ওয়াশিংটন হিল। হিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি তার ব্যবসাকে রাতারাতি দ্বিগুন করবার জন্য খুঁজছেন একজন যাদুকর। যাদুর পরশে ধুমপান বিষয়ে সমাজের নেতিবাচক ধারণাগুলোকে রাতের আধারে পাল্টে দিবেন যাদুকর । দিনের আলোতে মুখে মুখে রটবে ধুমপানের অজস্র গল্প-কথা। মূলত: হিল চাইছেন ধুমপান সম্পর্কিত সমাজের প্রচলিত ধারণার আমূল পরিবর্তন। সমাজে ধুমপান বান্ধব একটি নতুন মত প্রতিষ্ঠা করতে আজ তিনি মরিয়া। এর মধ্যেই নিহিত আছে তার আর্থিক ভবিষ্যৎ। গল্পের এই পর্যায়ে, পর্দায় আর্বিভাব করলেন এডওয়ার্ড বার্নেস। আমেরিকার সেই সময়কার তারকা খ্যাতির ব্যক্তিত্ব।
জর্জ ওয়াশিংটন হিল-এর প্রস্তাবে, বার্নেস জানতে চাইলেন : এই কাজে তোমার বাজেট কত?
: কত লাগবে? জানতে চাইলেন, হিল।
বিরক্ত হয়ে বার্নেস বললেন: আমায় বিরক্ত করো না ! আমি ব্যস্ত আছি।
খুব অবাক হলেন হিল। বললেন : “আমি জানি, তুমি ব্যস্ত! কিন্তু কাজটা আমার করতেই হবে। আর তাইতো তোমার কাছে আসা। টাকা যতই লাগে, লাগুক না কেন!”
এবার, বার্নেস-এর চোখের কোনে হাসি ফুটল! বললেন: “তার মানে তুমি বলতে চাইছ, এই কাজে তোমার বাজেট সীমাহীন! কিন্তু ফলাফল অবশ্যই চাই!”
জর্জ ওয়াশিংটন হিল সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়লেন এবং প্রসন্ন মুখে রাজী হলেন।
: আচ্ছা দেখি, তোমার জন্য কি করতে পারি! খুশি মুখে প্রত্যুত্তরে বললেন বার্নেস।
এরপর বার্নেস, একজন সমাজ মনোবিজ্ঞানীর দ্বারস্থ হলেন। জানতে চাইলেন, ধুমপান বিষয়ে সমাজে নারীদের মাঝে যে বিরূপ মনোভাব রয়েছে তার কারণ কি? কেন এই অনীহা? টাকা যা লাগে দেয়া হবে। বিনিময়ে, উত্তরটি হতে হবে ষোল আনা যথার্থ।
সমাজ মনোবিজ্ঞানী এ এ ব্রিল, সময় নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে জানালেন, আমেরিকান নারীদের কাছে সিগারেট হচ্ছে, এটি পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার প্রতীক। সামাজিক বৈষম্যের কারণে নারীরা পুরুষের ব্যবহৃত সিগারেট-এর মধ্যে নিজস্ব বঞ্চনার ইঙ্গিত পান। তাই সিগারেট-এর প্রতি তাদের নিজস্ব বিতৃষ্ণা কাজ করে এবং নিজস্ব সুরক্ষায় তারা, এই প্রবণতা থেকে দূরে থাকেন।
: আচ্ছা তাই নাকি? তুমি কি নিশ্চিত? এইটিই প্রকৃত কারণ? জানতে চাইলেন, বার্নেস।
: আমি আমার গবেষণায় ভুল করি না! বললেন, আত্মবিশ্বাসী এ এ ব্রিল।
বার্নেস, মনোবিজ্ঞানী এ এ ব্রিল-এর জবাবে সন্তষ্ট হয়ে এবার তার পরবর্তী পরিকল্পনায় নেমে গেলেন। সামনেই নিউইয়র্কে ইস্টার সানডে’র প্যারেড। বার্নেস দিনটিকে টার্গেট ধরে, এগিয়ে গেলেন নিজস্ব কর্মসূচি বাস্তবায়নে। পরিকল্পনা মাফিক নির্দিষ্ট দিনে, ইস্টার সানডে’র প্যারেড শুরু হতে চলেছে। জাতীয় স্টেডিয়াম জুড়ে অসংখ্য জনতার আনাগোনা চলছে। পুরো স্টেডিয়াম বলতে গেলে কানায় কানায় পূর্ণ। এমনি পরিস্থিতিতে, অসংখ্য জনতাকে তাক করে দিয়ে গোটা কয়েক নারী সেলিব্রিটি নিজেদের পোষাকের অবয়ব থেকে সিগারেট বের করলেন এবং জন সম্মুখে প্রজ্বলিত সিগারেটে সুখ টান দিতে লাগলেন। বিষয়টা অনেকটাই যেন, নিজস্ব আড্ডায় মশগুল কিছু স্বাবলম্ভী নারীর তীব্র আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সকল মানুষ অবাক হয়ে দেখছেন অবাক করা গল্পের মঞ্চায়ন। বার্নেস এখানেই থামলেন না। নিজস্ব কৌশলে প্যারেড প্রাঙ্গনে উপস্থিত সকল সংবাদ কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ঘটনাস্থলে ছুটে আসা সংবাদ কর্মী এবং ফটোগ্রাফারদের মাঝে বার্নেস বিতরণ করলেন নিজস্ব প্রেস রিলিজ, যার শিরোনাম হলো, “টর্চেস অব ফ্রিডম”। বার্নেস-এর প্রচারণার মূল বক্তব্য হচ্ছে, “সিগারেট নারী স্বাধীনতার প্রতীক, নারীর নিজস্ব টর্চ”। পরবর্তী দিন পত্রিকার প্রথম পাতায় টর্চেস অব ফ্রিডম বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্ক টাইমস-এর মধ্যে অন্যতম। দেশ জুড়ে মানুষ জানল সিজারেট হলো টর্চেস অব ফ্রিডম। প্রকাশিত সংবাদ-এর ভাষ্যকে দেশজুড়ে আরো তীব্র করণে এরপর প্রিন্ট ও রেডিও মিডিয়াতে প্রচারিত হলো অজ¯্র বিজ্ঞাপন । টর্চেস অব ফ্রিডম ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় আমেরিকা জুড়ে । এই জনপ্রিয়তা আজো প্রতিষ্ঠিত। আমেরিকাজুড়ে সিগারেট ব্যবসা রম রমা হারে বাড়তে লাগল। নিজের ব্যবসায়িক সাফল্যে আত্মহারা জর্জ ওয়াশিংটন হিল। অত্যন্ত কৃতজ্ঞ চিত্তে বার্নেসকে ধন্যবাদ জানালেন। মিডিয়ার কৌশলী ব্যবহারে ধূমপানের মত একটি অস্বাস্থ্যকর সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যাত বিষয়ে জনমতের আমূল পরিবর্তন ঘটালেন বার্নেস। কৌশলী এই প্রচারণা কার্যক্রম এত বছর পর আজও মিডিয়া বিশেজ্ঞদের একাডেমিক আলোচনার বিষয়।
সামষ্টিক জনমত বিনির্মাণে প্রিন্ট, অডিও এবং ভিডিও এককভাবে খুব কমই করতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা কৌশলী কর্মপরিকল্পনার পরিকল্পিত অংশীজন হয়ে গবেষণা লব্ধ প্রক্রিয়ায় সমন্বিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে। মূলত, পরিকল্পনাটি যদি সঠিকভাবে করা হয়ে থাকে এবং দ্বিতীয়ত, পর্যাপ্ত বাজেট সহায়তায় মিডিয়া আউটলেটগুলোর স্বার্থক ব্যবহার যদি করা যায়, তবে জনমত বিনির্মাণ কার্যক্রম সফল হতে বাধ্য। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বার্নেস-এর মতে, “যে ধারণা অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর মাঝে বিতরণ করা হয় তা লক্ষ্যদলের প্রাত্যহিক জীবনের অনুষঙ্গে পরিনত হয়”। মূলত মানুষ যখন কোন নতুন ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়, বিষয়টি দ্বারা কনভিন্স হয়, তখন লব্ধ ধারণাটি তার চিন্তনে প্রভাব ফেলে এবং পরবর্তীতে ব্যক্তিগত আচরণে তা প্রকাশিত হয়। আদর্শগত, রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা নির্বাচনী যুদ্ধ সকল ক্ষেত্রেই জনমত বিনির্মাণের প্রয়োগ ইতিহাসে ঘটানো হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এই প্রয়োগ অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা পোষণ করি। কিন্তু বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, এই প্রয়োগ যুগে যুগে কখনই দেবাৎ ঘটেনি।
মত বিনির্মাণ বিষয়ক লেখাটি শেষ করবার আগে, ২০০৭ সালে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং নিউ মিডিয়ার সমন্বয়ে বিবিসি কর্তৃক পরিচালিত একটি প্রচারণা কার্যক্রম সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করব। ভারতে এইডস রোগীর সংখ্যা এবং বিস্তারের সম্ভাবনা পাশ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশী । ২০০৬ সালের হিসাব মতে, আনুমানিক প্রায় ২৫ লাখ লোক ভারতে এইডস দ্বারা আক্রান্ত। ভারতের জাতীয় এইডস নিয়ন্ত্রণ সংস্থার হিসাব মতে আক্রান্তদের ৮৩%-এর এইডস বিস্তার ঘটেছে অনিরাপদ যৌন মিলন দ্বারা। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের গবেষণা অনুযায়ী, মাত্র ৭ % ভারতীয় সেক্স বিষয়ে উন্মুক্ত পরিবেশে খোলামেলা আলোচনা করে থাকেন। এ অবস্থায় দেশব্যাপী এইডস-এর বিস্তার কমিয়ে আনতে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টকরণ জরুরী একটি বিষয়। বিষয়টি নিয়ে প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে এগিয়ে আসেন তৎকালীন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ট্রাস্ট, যা বর্তমানে বিবিসি মিডিয়া এ্যাকসন নামে পরিচিত। বিবিসি’র প্রচারণার উদ্দেশ্য, নিরাপদ সেক্স বিষয়ে ভারতীয়দের আচরণগত পরিবর্তন সাধন এবং এর মাধ্যমে এইডস-এর প্রকোপ কমিয়ে আনা। মূলত বিল এন্ড মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়।
প্রচারণা কার্যক্রমে জনগণের আকর্ষণ টানতে একটি সবজান্তা টিয়া পাখী, একজন কৌশলী কাবাডি খেলোয়াড়, কনডম বিষয়ক রিংটোন এবং সবশেষে কনডম নামের একটি কুকুর ছানা শ্রোতা-দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা হয় । পুরো প্রচারণার সময় জুড়ে ধাপে ধাপে চরিত্রগুলো জনসমক্ষে উপস্থাপন করা হয়। ২০০৭ সালের ১লা ডিসেম্বর, বিশ্ব এইডস দিবসকে টার্গেট করে বেতার এবং টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন আকারে একটি ঘোষণা প্রচার করা হয়। এতে একটি উন্মুক্ত কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কুইজের উত্তর হচ্ছে “কনডম”। বিজ্ঞাপনের শুরুতে বলা হয়,
এটি পৌরুষের প্রতীক তবে গোঁফ নয়
সুরক্ষার প্রতীক তবে হেলমেট নয়
ছোট্ট এই বস্তু !
কোনও সন্দেহ নাই।
যে এর সম্বন্ধে আলোচনা না করে, সে যে পুরুষেই নাই!
…কি সেই ছোট্ট জিনিস?
এরপর শ্রোতা-দর্শকদের নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করে উত্তর জানাতে বলা হয়। বিজয়ীকে মোবাইল ফোন এবং ক্যামেরা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়। বিজ্ঞাপনটি বেতার, টিভি ছাড়াও দৈনিক পত্রিকা এবং বিলবোর্ডের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করা হয়। প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য শ্রোতা-দর্শক যেন কনডম বিষয়টি নিয়ে নিজস্ব গন্ডিতে আলোচনা করেন। তিন সপ্তাহব্যাপী এই কুইজ প্রতিযোগিতা ভারতের চারটি রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং তামিলনাড়– রাজ্য জুড়ে করা হয়। চারটি রাজ্যের ১০ কোটি মানুষের নিকট বার্তাটি পৌঁছানোর জন্য সকল ধরণের মিডিয়ার সহায়তা নেয়া হয়। মূলত এই রাজ্যগুলোতেই ভারতীয় এইডস রোগীদের ৮৩%-এর বসবাস। গবেষণায় দেখা যায়, প্রচারণার পর পরই চার লাখ মানুষ প্রশ্নের উত্তর দানের জন্য নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করে। ৮০% লোক বিজ্ঞাপনটি দেখার পর বন্ধু এবং সুহৃদ মহলে এই নিয়ে আলোচনা করেন। অবশেষে, সঠিক উত্তরদাতাদের মধ্য থেকে ২৫ জন সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকে লটারীর মাধ্যমে বিজয়ী নির্বাচিত করা হয় এবং ফ্রি টক টাইমসহ ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল ফোন উপহার দেয়া হয়।
কনডম নিয়ে লক্ষ্যদলের মাঝে সৃষ্ট আলোচনার আবহ চলমান রাখতে এর পরের ধাপেই ব্যবহার করা হয় ঐতিহ্যবাহী কাবাডি খেলার কৌশল। একজন বুদ্ধিমান খেলোয়াড় দু’পক্ষের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের শেষ ধাপে এসে কাবাডি কাবাডি বলে ডাক দেয়ার পরিবর্তে কনডম কনডম বলে ডাক দেয় । বিপক্ষ দল কনডম শব্দ শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং এই সুযোগে কৌশলী কাবাডি খেলোয়ার নিজ দলকে জয়ী করতে শেষ দান মারেন এবং জয়ী করে তোলেন। বেতার এবং টেলিভিশনে এই কাবাডি ম্যাচ সম্পর্কে প্রচারণা অব্যাহত থাকে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিষয়টির উপর বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়। পরবর্তীতে, তিনটি দৈনিক পত্রিকাতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে খেলায় ব্যবহৃত “কনডম কনডম বলে ডাক দেয়া” সম্পর্কে পাঠক মতামত জানতে চেয়ে নির্দিষ্ট নম্বরে এসএমএস করতে অনুরোধ জানানো হয়। পত্রিকায় বলা হয়, “বুদ্ধিমান লোক কনডম সম্পর্কে আলোচনা করে” -যদি এই বাক্যের সাথে একমত হন তবে ইয়েস লিখে এসএমএস করুন অন্যথায় নো লিখে এসএমএস করুন। গবেষণায় দেখা যায়, যে সকল পাঠক জবাব দিয়েছেন তাদের ৮৯% প্রচারণার বক্তব্যের সাথে অর্থ্যাৎ বুদ্ধিমান লোক কনডম সম্পর্কে আলোচনা করে -মর্মে একমত পোষণ করেছেন।
এবার প্রচারণার তৃতীয় ধাপ। কনডম শব্দ নিয়ে অব্যাহত আলোচনাকে ব্যক্তির প্রাত্যহিক জীবনে আনবার প্রথম প্রয়াস। বিবিসি’র গবেষণায় দেখা যায়, ভারত বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল মোবাইল বাজারগুলোর একটি, যেখানে ২০০৭ সালের হিসেবে ৬০ কোটি মোবাইল ব্যবহারকারী রয়েছেন। বিশাল সংখ্যার এই মোবাইল ব্যবহারকারীদের মাঝে কনডম শব্দটিকে প্রাত্যহিক শব্দে পরিনত করার জন্য কনডম শব্দটি দিয়ে একটি রিংটোন তৈরি করা হয়। বিজ্ঞাপন আকারে রিং টোনটি সম্পর্কে বেতার এবং টেলিভিশনে ব্যাপক প্রচারণা করা হয় এবং লক্ষ্যদলকে জানান দেয়া হয়। বিবাহ উত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে, এক অতিথি অপর অতিথির নতুন মোবাইল ফোন দেখে মুগ্ধ হন এবং নিজ হাতে নিয়ে ফোনের অপসনসমূহ দেখতে থাকেন। এমতাবস্থায়, মোবাইলে কল আসলে রিংটোন বেজে উঠে। নতুন মোবাইলে অনভ্যস্থতার কারণে নবীন ব্যবহারকারী মোবাইলের রিং টোন অফ করতে পারছিলেন না । এদিকে বেজে চলা কনডম কনডম রিংটোনের আওয়াজে তিনি ভীষণভাবে অস্বস্তি বোধ করছেন। সংকটজনক এমন নাকাল অবস্থায়, অনুষ্ঠানে আগত এক অতিথি রিংটোনটির প্রশংসা করেন। মুহুর্তে পুরো দৃশ্যপটের পরিবর্তন । অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল অতিথিরা কনডম রিংটোনের প্রকাশ্য ব্যবহারে ব্যক্তিকে দায়িত্ববান এবং স্মার্ট হিসেবে হাত তালি দিয়ে স্বীকৃতি দেন।
মোবাইল ফোনে এসএমএস-এর মাধ্যমে রিং টোনটি ডাউনলোডের সুযোগ রাখা হয় এবং একই সাথে পৃথক ওয়েব সাইট চালু করা হয়, যাতে প্রয়োজনে সেখান থেকেও বিকল্প পথে ডাউনলোড করা যায়। রিং টোনটি ডাউনলোডের জন্য পাঁচ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার এসএমএস অনুরোধ আসে এবং ওয়েব প্লাটফর্মে আরও দুই লক্ষ অনুরোধ আসে সারা পৃথিবী থেকে। বলা হয়ে থাকে, কনডম কনডম রিংটোনটি পৃথিবীর প্রথম ননভার্বাল জনস্বাস্থ্য বিষয়ক যোগাযোগ উপকরণ। রিং টোনটির এই সফলতার পর এটির উপর ভিত্তি করে টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ/ ফিচার প্রকাশিত হয়। সিএনএন রিং টোন টির উপর অনুষ্ঠান প্রচার করে। কনডম কনডম রিং টোনটিতে শুধুমাত্র কনডম শব্দটি বার বার বিভিন্ন সুরে এবং গতিতে তুলে ধরা হয়। এ প্রসঙ্গে, রিংটোনটির কম্পোজার রুপার্ট ফার্নান্দেজ এবং বিজয় প্রকাশ বলেন, “আমাদের সমাজে প্রকাশ্যে কনডম সম্পর্কে আলোচনা করতে আমরা অস্বস্তি বোধ করে থাকি। সুতরাং, আমরা চেয়েছি কনডম-এই একটি শব্দ ব্যবহার করে একটি কনভার্সেশন পিস তৈরি করতে, যেটি মানুষ শুনে নিজের আড্ডার জগতে আলোচনা করতে উৎসাহিত হবেন এবং এর ফলশ্রুতিতে কনডম শব্দ নিয়ে আমাদের যে সামাজিক সীমাবদ্ধতা আছে, তা কিছুটা হলেও কমে আসবে”। তারা আশা করেন, এই ভাবে “কনডম” শব্দটি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে একটি সহজ শব্দে পরিণত হবে।
এবার প্রচারণার শেষ ধাপ। কনডম বিষয়ক চলমান আলোচনা সাইন অফ-এর পালা। এই পর্বেও কনডম নিয়ে আলোচনা চলমান থাকে। তবে এবার, কনডম একটি কুকুর ছানা। টেলিভিশনে দেখা যায়, এক বয়োজ্যেষ্ঠ নারী একটি কুকুর ছানাকে আদর করছেন। আদর করতে করতে তিনি-এর মালিকের নিকট নাম জানতে চান? জানতে পারেন, কুকুর ছানাটির নাম কনডম! বেশ অবাক হন। তবে, পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নেন। জড়িয়ে ধরেন কুকুর ছানাটিকে এবং কনডম কনডম বলে আদর করতে থাকেন। এ অবস্থায়, একজন ফোঁড়ন কাটেন, “ছি! কনডম বলতে, একটু লজ্জাও লাগছে না!” বিরক্ত বয়োজ্যেষ্ঠ নারী বলেন, “চুপ, বেকুব! কনডম শব্দের মাঝে খারাপ কিছু নেই। খারাপ যা আছে, তা মানুষের বোঝার মধ্যেই আছে”। মূলতঃ সর্বশেষ ধাপটিতে, একটি সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কনডম শব্দটির অর্থ জানা এবং নিরাপদ জীবন পরিচালনা -এই দুইয়ের সম্পর্কই এখানে মূল বক্তব্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সমগ্র প্রচারণাটি করা হয়েছে, এইডস-এর বিস্তার কমিয়ে আনবার জন্য। কিন্তু প্রচারণার কোথাও একটি বারের জন্যও এইডস শব্দটি উচ্চারণ করা হয়নি। পুরো প্রচারণা প্রক্রিয়ায়, বাজেটের নিশ্চয়তা ছিল শতভাগ।
প্রচারণা কার্যক্রমকে সফল করার জন্য উন্নত কন্টেন্ট-এর পাশাপাশি বক্তব্য লক্ষ্যদলের সকল অংশে সুষমভাবে ছড়িয়ে দেবার জন্য যেখানে যেটি প্রয়োজন রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, মোবাইল ফোন, এসএমএস, ল্যান্ড ফোন, ব্যানার, পোস্টার, লিফলেট, সাইনবোর্ড, প্রণোদনা, নিউ মিডিয়া সব কিছুই পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক ব্যবহার করা হয়েছে। প্রচারণাকে আরো ইন্টারএ্যাকটিভ করার জন্য ওয়েব সাইট এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যুক্ত করা হয়েছে। প্রচারণায় সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে লক্ষ্যদলের মাঝে নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা চলার জন্য ডিমান্ড সৃষ্টি করা হয়েছে। আলোচনা চলমান রাখার জন্য উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে এবং লক্ষ্যদলকে কনভিন্স করার জন্য মূল উদ্দেশ্য এইডস দমন হলেও, পুরো প্রচারণায় একটি বারের জন্যও এইডস শব্দটি উল্লেখ না করে বরং অন্যান্য শব্দের হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপন করে শ্রোতাকে মুগ্ধ এবং আকৃষ্ট করে কার্যক্রমের সাথে যুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। শ্রোতার মননে আরো দাগ কাঁটার জন্য প্রচারণায় একটি লোগো, একটি সার্বক্ষনিক শ্লোগান এবং নির্দিষ্ট মাসকাট ব্যবহার করা হয়েছে। সব শেষ ধাপে, কনডম ব্যবহারকারীকে সামাজিক সফল ও নিরাপদ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস রচনা করা হয়েছে। কার্যক্রমটির সফলতার কারণে পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় এইডস নিয়ন্ত্রণ সংস্থা প্রচারণাটিকে জনস্বার্থে দেশব্যাপী এগিয়ে নিয়ে চলেন। গবেষণায় দেখা গেছে, এই প্রচারণার ফলে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ এইডস সম্পর্কে জানতে পারে।
এডওয়ার্ড বার্নেস যখন মানুষের আচরণ পরিবর্তন ও জনমত বিনির্মাণে কাজ করছিলেন তখন তার কাজের ধরণে বাজেটের নিশ্চয়তা ছিল শতভাগ। চিন্তায় ছিলেন যুগের চেয়ে অধিক সৃজনশীল। মিডিয়ার সকল শাখার সফল ব্যবহার ছিল তার কৌশলী অস্ত্র। পরবর্তীতে আশি বছর পরে এসে বিবিসি যখন জনমত বিনির্মাণে মাঠে কাজ করছে, তারাও বাজেটের নিশ্চয়তা শতভাগ বজায় রেখেই কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছেন। মিডিয়ার সকল শাখার সমন্বিত ব্যবহারে বিবিসি আরো অধিক উদ্ভাবনী মেধার প্রয়োগ দেখাচ্ছেন। কার্যক্রম পরিচালনায় বাজেটের নিশ্চয়তা শতভাগ বলতে এখানে লক্ষ্য অর্জনে বাজেটের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণের স্বাধীনতাকে নির্দেশ করা হচ্ছে। এইটি যখন থাকে তখন জনমতের ইতিবাচক পরিবর্তন কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া নিশ্চিতভাবে সম্ভবরপর হয়। আর এই “সম্ভবপর কার্যক্রম” সমাজ বিনির্মাণে একটি দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগ। এটিকে খরচের খাতায় না বসিয়ে বরং বিনিয়োগের হিসাবটা মিলিয়ে দেখা জরুরী। মূলত, সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে সমাজ বদলানোর চেষ্টা করা উচিত নয় বরং প্রয়োজন সমাজ বদলানোর জন্য সঠিক প্রশ্নগুলো তুলে ধরা এবং বিকল্প উত্তরগুলো খোজাঁর জন্য শ্রোতা-দর্শকদের উদ্বুদ্ধ করা। উত্তর যদি সঠিক হয়, সমাজ নিজ থেকেই বদলাতে শুরু করে। এই সহজ কৌশলে জনমত বিনির্মাণ যুগে যুগে দেশে দেশে হয়েছে। আমাদের দেশেও হবে, যখন বিনিয়োগ সীমাটা স্বাধীনভাবে আমরা লিখতে পারব! নিশ্চয়ই।
লেখক: দেওয়ান মোহাম্মদ আহসান হাবীব, বাংলাদেশ বেতার সদর দপ্তরে উপপরিচালক পদে কর্মরত।
————————————————-
তথ্য সূত্র:
Bernays Edward L, The Engineering of Consent, PP:113-120 (Available at: http://www.mcnuttphysics.com/uploads/2/3/6/9/23694535/engineering_of_consent-edward_l_bernays.pdf, date: 18 July 2018).
Bernays Edward L (1928), Manipulating Public Opinion: The why and the how, American Journal of Sociolige, Vol: 33, Issue: 6 (May, 1928), The University of Chicago Press, Chicago, USA (Available at: http://www.rexsresources.com/uploads/6/5/2/1/6521405/bernays-manipulatingpublicopinion.pdf, date: 18 July 2018).
Bill and Melinda Gates Foundation (2011), Closing the Bridge: Avahan’s HIV Prevention Rrograms with Clients of Female Sex Workers in India, version 1, July 2011, USA, PP 24-25.
British Broadcasting Corporation, History of the BBC, United Kingdom (Available at: https://www.bbc.co.uk/historyofthebbc/research/culture/reith-1, date: 18 July 2018).
BBC Documentary (2002), The Century of the Self – Part 1: “Happiness Machines” written and produced by Adam Curtis, available at: https://www.youtube.com/watch?v=DnPmg0R1M04
BBC Media Action (2013), Condom is Just Another Word, available at: https://www.bbc.co.uk/mediaaction/where-we-work/asia/india/condom-condom and https://www.youtube.com/watch?v=ks1Y7h-JaVY
BBC News (2017), The blackboard Albert Einstein left in Oxford in the 1930s, United Kingdom (Available at: https://www.bbc.com/news/av/uk-england-oxfordshire-41096926/the-blackboard-albert-einstein-left-in-oxford-in-the-1930s)
BBC Radio Four, The History of Desert Island Discs, Available at: http://www.bbc.co.uk/programmes/articles/59YrnYM0Tw8J7WJ0MGKVfh7/the-history-of-desert-island-discs.
BBC World Service Trust, Annual Review 2009/10, Transforming Lives Through Media, United Kingdom.
BBC World Service Trust, Annual Review 2008/09, Transforming Lives Through Media, United Kingdom.
Constitution of the Peoples’ Republic of Bangladesh, Article 39, Government of Bangladesh, Bangladesh. (Available at: http://bdlaws.minlaw.gov.bd/print_sections_all.php?id=367)
Chris Koenig (2012), How Einstein fled from the Nazis to an Oxford college, The Oxford Times, United Kingdom (Available at: http://www.oxfordtimes.co.uk/leisure/history_heritage/9617968.How_Einstein_fled_from_the_Nazis_to_an_Oxford_college/)
Dipak Suryawanshi, Sangram Kishor Patel, Rajatashuvra Adhikary and etal (2016), Does mass-media public communication campaign normalize discussion, attitude and behavior about condom use among married men in India?, Journal of AIDS and Clinical Research, School of Health Systems Studies, Tata Institute of Social Sciences, Mumbai, India, Vol-7, Issue-8, July, 2016, PP:7-9
Elizabeth Smith (2012), A Road Map to Public Service Broadcasting, Asia Pacific Broadcasting Union (ABU), Malaysia, PP: 28-30.
Habermas, J. (1992) Further Reflections on the Public Sphere. In Calhoun, C. (ed.), Habermas and the Public Sphere, Cambridge, MA: MIT Press.
Jo Bardoel and Gregory Ferrell Lowe, From Public Service Broadcasting to Public Service Media : The Core Challenge in Gregory Ferrell Lowe and Jo Bardoel (eds) From Public Service Broadcasting to Public service Media RIPE@2007, Nordicom, Sweden, PP:11-15.
Lauren B. Frank, Joyee S. Chatterjee, Sonal T. Chaudhuri and etal (2012), Conversation and Compliance : Role of International Discussion and Social Norms in Public Communication Campaigns, Journal of Health Communication: International Perspectives, India, July, 2012, PP 1051-1056.
Lloyd John and Toogood Laura (2015), Journalism and PR : News Media and Public Relations in the Digital Age, I.B. Tauras & Co in association with the Reuters Institute for the Study of Journalism, University of Oxford, London, PP:3-5
Oxford (2015), Edward Bernays’s “Torches of Freedom”, Oxford University Press. Available at: http://www.oxfordpresents.com/ms/kelleher/edward-bernayss-torches-of-freedom/
Paul Rulkens (2014), Why the majority is always wrong, TEDx Maastricht, Netherland (Available at: http://agrippaci.com/ and also at: https://www.youtube.com/watch?v=VNGFep6rncY/ ).
Scannell, P. (1992) Public Service Broadcasting and Modern Public Life. In Scannell, P., Schlesinger, P. and Sparks, C. (eds) Culture and Power, London: Sage.
Slavko Splichal (2007), Does Hostory Matter? Grasping the Idea of Public Service Media at Its Roots in Gregory Ferrell Lowe and Jo Bardoel (eds) From Public Service Broadcasting to Public service Media, RIPE@2007, Nordicom, Sweden, PP:237-241.
Tatiane Leal, João Freire Filho and Everardo Rocha (2016), Torches of Freedom: Women, cigarettes and consumption, comun. mídia consumo, v. 13, n. 38, são paulo, Brazil, PP: 47-70 (Available at: http://revistacmc.espm.br)
Wikipedia, Article on Albert Einstein, Available at: https://en.wikipedia.org/wiki/Albert_Einstein, Date: 23 July 2018.
Wikipedia, Article on Vox Populi, vox dei, Available at: https://en.wikipedia.org/wiki/Vox_Populi,_Vox_Dei, Date: 23 July 2018.
————————————————-
Recent Comments / সর্বশেষ মতামত