বর্তমান বিশ্বে ফেসবুক, টুইটারের পর ইউটিউব অন্যতম বৃহৎ সামাজিক যোগাযোগ প্লাটফর্ম। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সঙ্গীতের প্রসারে সোস্যাল মিডিয়ার ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। শিল্পী কনা’র রেশমী চুরি গানটি ইউটিউবে আজকের তারিখে প্রায় ৯২ লাখ ৫৫ হাজার দর্শক অবলোকন করেছে। একইভাবে আরও অনেক সঙ্গীত শিল্পী নিজস্ব এ্যালবামের গানটি আরও শ্রোতাপ্রিয়তা অর্জনের জন্য ইউটিউবে আপলোড করে থাকেন। বোধ করি দৃশ্যমান দ্রুত ফলাফল প্রাপ্তি থেকেই তারা এমনটি করে থাকেন। যদিও আমাদের দেশে সঙ্গীতের প্রসারে শিল্পীর প্রনোদনা সৃষ্টির জন্য স্পটিফাই কিংবা বিবিসি রেডিও ওয়ান-এর মতো কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত এখনও গড়ে উঠেনি। গত এক দশকে আমাদের দেশের সঙ্গীত জগতের যে গুনগত বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তাতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এবং শিল্পীদের মণণ-এর বিকাশে এদেশের সঙ্গীত শিল্পকে আরও এগিয়ে নেয়ার জন্য সঙ্গীতের বিশ্বায়নে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত রচনা করা। বাংলা গান, বাংলা সুর পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম ভাষাকে প্রতিনিধিত্ব করে। সারা বিশ্ব জুড়ে যে অসংখ্য বাঙ্গালী ছড়িয়ে আছে, তাদের মাঝে জনপ্রিয়, মানসম্মত, এবং সর্বশেষ বাংলা মিউজিক ট্র্যাকের মূর্ছণা ছড়িয়ে দেবার জন্য আজ সময়ের দাবী প্রাতিষ্ঠানিক অনলাইন সম্প্রচার। সরকারী সংস্থার পক্ষে এটি সম্ভব হলে সোনায় সোহাগা, তবে বিকল্পভাবে হলেও তা সাদরে গ্রহণযোগ্য।
মিডিয়া গবেষক চিগন্যাল ২০০৯ সালে এক আলোচনায় বলেন, পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং-এ নিয়োজিত সংস্থার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট মাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের উপযোগিতা রাখে। ইন্টারনেট এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে সকল সামাজিক শ্রেণি নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম। ইন্টারনেট প্রযুক্তির স্পর্শে সমাজের সংখ্যা লঘুর কন্ঠস্বর কোনও অস্পষ্ট ওয়েব সাইটে আটকে থাকে না বরং এটি এমন পরশ পাথর যার পরশে অস্পৃশ্যের কন্ঠস্বর জন সম্মুখে উথ্থাপিত হয় । চিগন্যাল আরও বলেন, “ উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রায়শ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং-এর জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এটি জনস্বার্থে সম্প্রচারে নিয়োজিত সংস্থার জন্য বিশাল সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টিতেও সমান পারদর্শী।” উদাহরণ হিসেবে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের বহুল প্রশংসিত বিবিসি ডট কম ওয়েবসাইটের প্রসঙ্গ তুলে ধরা যায়। পূর্বে বিবিসির কার্যক্রম মূলত প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা বিবিসি রেডিও এবং বিবিসি টেলিভিশন। কিন্তু এখন এই কার্যক্রমে তৃতীয় প্রধান স্তম্ভ হলো বিবিসি অনলাইন, যেটি গড়ে উঠেছে বিবিসি ডট কমকে ভিত্তি করে। বিবিসির মূল্যবোধসমূহকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে রেডিও এবং টেলিভিশন মিডিয়ার সাথে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে বিবিসি অনলাইন। সারা দুনিয়াব্যাপী নিজস্ব শ্রোতা ও দর্শক আকৃষ্টকরণে বিবিসি রেডিও এবং বিবিসি টেলিভিশনের প্রসারে বিবিসি অনলাইন নতুন সুযোগের সৃষ্টি করেছে এবং বহুল প্রশংসিত গণমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
রেডিও, টেলিভিশন এবং প্রিন্ট মিডিয়ার উপকরণ সমূহের এক অসাধারণ যুগপৎ উপস্থাপন বিবিসি অনলাইন। মিডিয়া গবেষকগণ এই ত্রিমাতৃক মিথ-উপস্থাপন কৌশলকে তাদের ভাষায় মিডিয়া কনভার্জেন্স নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। মূলত বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে বেতার যন্ত্রের যখন আবিষ্কার তখন থেকে মিডিয়া হিসেবে প্রিন্ট মিডিয়ার আদল থেকে বেড় হয়ে স্বতন্ত্র যাত্রা শুরু করে বেতার মাধ্যম। এরপর যোগ হয় টেলিভিশন। প্রিন্টসহ প্রতিটি মিডিয়া নিজস্ব স্বাতন্ত্র অবস্থান নিয়ে সমাজ বিনির্মানে সমাজিক দর্পণ হিসেবে কাজ করতে থাকে। এরপর বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে কম্পিউটার প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী প্রসার প্রতিটি স্বতন্ত্র মিডিয়াকে কম্পিউটার প্রযুক্তির সাথে ক্রমশ একীভূত করে তোলে। মূলত কন্টেন্ট, কম্পিউটার এবং কম্যুনিকেশন-এই তিনের ধারাবাহিক সুষম একীভূতকরণের সামষ্টিক ফলাফল হচ্ছে মিডিয়া কনভার্জেন্স। আজকের দিনে একজন সঙ্গীত শিল্পী শুধু অডিও এ্যালবাম রিলিজ করেই খ্যাতি প্রত্যাশা করেন না, বরং নিজের প্রচারের জন্য একই সাথে ভিডিও এ্যালবাম, প্রিন্ট মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন এবং সবশেষে ইউটিউবে আপলোড সহ ফেসবুক/টুইটার-এ ভাইরাল সৃষ্টির জন্য নানা কসরত করে থাকেন। সুতরাং অনলাইন এবং নিউ মিডিয়ার ক্রম বিকাশে একক মিডিয়া সুপ্রিমেসি ধীরে ধীরে কমে আসছে। আবার একই সাথে এটিও সত্য প্রতিটি মিডিয়া তার নিজস্ব গুরুত্ব আরও বিকশিত পরিসরে প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন নিউমিডিয়ার আর্শিবাদে। উদাহরণ স্বরূপ, বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র অডিও মিডিয়ার সহায়তায় স্পটিফাই কিংবা বিটস-১ এর মাধ্যমে একজন শিল্পী যতটা সহজে বিশ্বব্যাপী নিজের গান ছড়িয়ে দিতে পারছেন, এমনটি পূর্বে কখনও দেখা যায়নি । এটি বিশ্বায়নের অসাধারণ অর্জণ। এই অর্জনকে কাজে লাগিয়ে আমরা কি পারি না প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা সঙ্গীতের বিশ্বায়নে আরো একটু এগিয়ে যেতে?
-আহসান
২১ জুন ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ
মধুবাজার, ঢাকা।